Monday, 5 December 2016

ঐতিহ্যবাহী সান্তাহার রেলওয়ে জংশন স্টেশন নানা সমস্যায় জর্জড়িত

 

বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি ঐতিহ্যবাহী ও বৃহত্তম স্টেশন সান্তাহার জংশন রেলওয়ে স্টেশনটি। এটি রাণীনগর রেলওয়ে স্টেশনের উত্তর দিকের পার্শ্ববর্তী প্রসিদ্ধ একটি জংশন স্টেশন। বৃটিশ আমলে নির্মিত এই জংশন স্টেশনটি শুধু ব্রডগ্রেইজ লাইনে ট্রেন চলাচলের সময় ‘‘সান্তাহার স্টেশন’’ নামে পরিচিত ছিল। অবিভক্ত ভারতের উত্তরবঙ্গ ও আসাম, ত্রিপুরা ও নাগাল্যান্ডের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার যোগাযোগ সহজতর করার লক্ষ্যে সান্তাহারকে সংযুক্ত করে পূর্ব দিকে বগুড়া হয়ে দিনাপুর,রংপুর ও লালমনিরহাটে যাওয়ার আরো একটি রেললাইন (মিটারগেজ) নির্মিত হলে ‘‘সান্তাহার স্টেশন’’ সান্তাহার জংশন স্টেশনে পরিণত হয়।
ত্রিমুখী রেলের সংযোগ স্থল এবং নওগাঁ ও বগুড়া এই দুই জেলার মোহনায় অবস্থিত এই স্টেশনটি নানা দিক দিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং এই স্টেশন থেকে সরকারের আয় উল্লেখ করার মতো। গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এই স্টেশনের মোট আয় ৭ কোটি ১০ লক্ষ ৪১ হাজার ৩৪৭ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ আয় হওয়া সত্ত্বেও জনবল সমস্যা, স্টেশনের ফেন্সিং ওয়াল বা বাউন্ডারী ওয়াল না থাকা, স্টেশনে প্রয়োজনের তুলনায় জনবল সংকট, পানি সমস্যা ইত্যাদি কারণে সান্তাহার জংশন স্টেশনটি তার পুরোন ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে যে, স্টেশনের ১নং প্লাটফরম হতে ৪নং প্লাটফরমের টিনশেড গুলি ফুটো হয়ে জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়েছে। বহুদিন আগে শেডের টিনগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়াতে অধিকাংশ স্থানেই বৃষ্টির পানি পড়ে স্টেশন নোংড়া হয়ে যায়। যাত্রীরা ট্রেনে উঠা নামা করতে পারে না। স্টেশনের অনুমোদিত দোকানদারদের মালামাল ভিজে যায়। স্টেশনের লাইন, ফ্যান নষ্ট হয়ে যায়। পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের অনেক স্টেশন আধুনিক ও উন্নত হলেও প্রসিদ্ধ সান্তাহার জংশন স্টেশনে আধুনিকতা আজও স্পর্শ করেনি। ফলে যাত্রী সেবার মান বাড়েনি। পশ্চিমাঞ্চলের সান্তাহার গুরুত্বপূর্ণ রেল জংশন হলেও এখানে টিকিটের আসন সংখ্যা বাড়েনি। বিভিন্ন যাত্রীদের সাথে কথা বললে তারা অভিযোগ করে বলেন যে, যাত্রী সেবার মান উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে । বর্ষাকালে স্টেশনের টিনের ছাউনির নিচে দাঁড়ানো যায় না। টিনের ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে শরীর ভিজে যায়। গরমের সময় স্টেশনের অধিকাংশ ফ্যান নষ্ট থাকে। পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। বৃট্রিশ আমলে তৈরি বিশ্রামাগার গুলোর দীর্ঘদিন কোন সংস্কার না করায় সেগুলোতে বসে অপেক্ষা করার মত জো নেই। নেই খাবার খাওয়ার মান সম্মত কোন হোটেলের ব্যবস্থা। উত্তরাঞ্চলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম এ জংশন স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন শত শত যাত্রী যাতায়াত করে। স্টেশনটির উপর দিয়ে আন্ত ঃনগর, মেইল, সাধারণ মেইল, মালামাল গাড়িসহ প্রায় ৩০টি ট্রেন প্রতিদিন চলাচল করে। স্টেশন মাষ্টারের অফিস সূত্রে জানা যায় প্রয়োজনের তুলনায় চরম জনবল সংকট স্টেশনটিতে। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সহকারী স্টেশন মাষ্টারের পদসহ ১৫টি পদ থাকলেও বর্তমানে মাত্র ২ জন কর্মরত ও চুক্তিভিত্তিক ২ জন সহকারী স্টেশন মাষ্টার রয়েছে। অনেক সময় পোটার দ্বারা এই পদের কাজ সমাধান করতে হয় বলে জানা গেছে। ১ম শ্রেণী পুরুষ ও মহিলা বিশ্রামাগার ২ জন আয়া থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছে একজন। ২য় শ্রেণী বিশ্রামাগারে কোন আয়া নেই। বিশ্রামাগার গুলির মধ্যে প্রথম শ্রেণীর পুরুষ বিশ্রামাগার অধিকাংশ সময় বন্ধ অথবা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের থাকতে দেখা যায়। বিশ্রামাগার গুলির টয়লেটে অধিকাংশ সময় পানি থাকে না। দরজা গুলির সিটকানি সারা বছরই প্রায় নষ্ট থাকে বলে যাত্রীদের অভিযোগ। বিশ্রামাগার গুলিতে আসন ব্যবস্থা অপ্রতুল। স্টেশনের টয়লেট ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত, অপরিচ্ছন্ন হওয়ায় যাত্রীরা ও বহিরাগতরা মলমূত্র ত্যাগ করে রেল লাইন সংলগ্ন পাবলিক টয়লেটে এবং খোলা এলাকায়। ফলে ১নং প্লাটফর্মে ও ৪,৫ নং প্লাটফর্ম দিয়ে যেতে লাগলে যাত্রীদের মুখে রুমাল দিতে হয়। স্টেশনটিতে সম্প্রতি কিছু যাত্রী বসার আসন দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন পূর্বে যোগদান করা স্টেশন মাষ্টার রেজাউল করিম ডালিম টিকিটের কালোবাজারী ও মাদকসেবীদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া স্টেশন সংলগ্ন যানজট নিরসনে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে তিনি যোগাযোগ রক্ষা করেছেন বলে তিনি জানান। গত ৪ এপ্রিল রেলের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা গর্ভমেন্ট ইন্সপেক্টর অব বাংলাদেশ রেলওয়ে (জেআইবিআর) সান্তাহার জংশন স্টেশন পরিদর্শনের সময় স্টেশনের পার্শ্ববর্তী এবং রেলগেট সংলগ্ন এলাকায় প্রভাবশালীদের ইন্দনে অবৈধভাবে গড়ে তোলা সমস্ত দোকানপাট, মার্কেট উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেন। বহু বিতর্কিত দুটি মার্কেট ভেঙ্গে ফেলা হয়। উদচ্ছেদের কিছুদিন পরেই প্রভাবশালীদের ইন্দনে সেই সমস্ত অধিকাংশ এলাকায় দোকানপাট আবারো বসা শুরু করে। গত ৪এপ্রিল এই এলাকা দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেলে স্টেশন চত্বরে ৩টি বড় গাছ পড়ে যায়। মূল্যবান ঐ গাছগুলির ডালপালা কে বা কারা কেটে নিয়ে গেছে। গাছগুলি এখনো ঐ অবস্থায় পড়ে আছে। গত আড়াই মাসেও বিষয়টি সুরাহা করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সান্তাহার জংশন স্টেশনটিতে পানির সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বৃহৎ এই স্টেশনে মাত্র ২টি টিউবয়েল এবং ১টি পানির ট্যাপের ব্যবস্থা আছে। সেগুলো প্রায় সময়ই বন্ধ অথবা নষ্ট থাকে বলে অনেকের অভিযোগ। সারা দিনে মাত্র দুই বার পানি সরবরাহ করা হয়। বিশ্রামাগার গুলোতেও অধিকাংশ সময় পানি থাকে না। ফলে যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে। স্টেশনটির ১,২ ও ৩ নম্বর প্লাটফর্মে ১৮টি বৈদ্যুতিক ফ্যানের ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলোর অধিকাংশ নষ্ট হয়ে থাকে। ৪ ও ৫ নম্বর প্লাটফর্মে কোনো ফ্যানের ব্যবস্থা নেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, টিনসেড নষ্ট হওয়াতে পানি পড়ে প্রায় ফ্যান, লাইট নষ্ট হয়ে যায়। জি আর পি থানা থেকে রেলগেট পর্যন্ত স্টেশনটির প্রবেশ পথ কাঁচা ও কম আলো যুক্ত। ঐ রাস্তা দিয়ে দিনে ও রাতে অনেক রেল যাত্রী ও পোস্ট অফিসের গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র, মালামাল পারাপার করেন। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তাটিতে পানি জমে যায়। ফলে যাত্রীদের ও পোস্ট অফিসের কর্মচারীদের ঐ রাস্তায় ভোগান্তি বেড়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া স্টেশনটিতে মোবাইল চুরি এখন নিত্যদিনের ঘটনা। জংশন স্টেশনটিতে নেই কোন প্রথম শ্রেণীর হোটেল। আশির দশকে “উচ্চশ্রেণীর ভোজনালয়” নামে একটি উন্নত মানের হোটেল এবং দক্ষিণ পাশে ‘‘মুসলিম’’ ও ‘‘হিন্দু’’ নামে দুটি হোটেল ছিল। বর্তমানে এগুলির পরিবর্তে অনুন্নত ২টি রেষ্টুরেন্ট হয়েছে যেগুলোতে বসে খাবার খাওয়ার কোন পরিবেশ নেই। সান্তাহার স্টেশনের কোন ফেন্সিং ওয়াল বা বাউন্ডারী ওয়াল নেই। ফলে একদিকে বিনা টিকেটের যাত্রীদের সনাক্ত করা যায় না অপরদিকে স্টেশনে ইভটেজার ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের উৎপাত বেড়েছে। গত ৮-৬-১৫ ইং তারিখে পাকশী বিভাগীয় ব্যবস্থাপক সহ বেশ কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সান্তাহার স্টেশন পরিদর্শনে এলে সান্তাহার রেলওয়ে শ্রমিক লীগ ৭ দফা দাবি সম্বলিত একটি স্মারক লিপি পেশ করেন। ঐ দিন নাগরিক কমিটির যুগ্ম সম্পাদক রবিউল ইসলাম রবীন সংগঠনের পক্ষে মৌখিক বক্তব্য পেশ করেন। নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক একজন স্টেশনের কর্মকর্তা বলেন, এই অবস্থায় “স্টেশন উন্নয়ন পরিষদ” গঠন করা যেতে পারে। যেখানে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বশীল ও দায়িত্বশীল অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা স্টেশনটির ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে মতামত প্রদান করবে। সান্তাহার পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোরশেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘সান্তাহার স্টেশন একটি ঐতিহ্যবাহী স্টেশন। এর উন্নতিকল্পে স্টেশন কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে বিভিন্ন অভিজ্ঞ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের সাথে মত বিনিময় করতে পারে। আমরা এই বিষয়ে সর্বদা সাহায্য করবো। সান্তাহার নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ মোসলেম উদ্দীন বলেন, সান্তাহার স্টেশনের সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনে আমরা আন্দোলনে যাব। এ প্রসঙ্গে স্টেশন মাষ্টার রেজাউল করিম ডালিম বলেন ‘‘বাউন্ডারী ওয়াল না থাকায় সান্তাহার জংশন স্টেশনটি আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং জনবল সংকট থাকায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত সেবা প্রদানে সক্ষম হওয়া যাচ্ছে না। আমি স্টেশন বিষয়ে সরকার এবং সর্বসাধারণের সহযোগিতা চাই। চোরাকারবারিদের দাপট কমানোর জন্যে এখানে আরও অধিক পরিমাণে পুলিশ প্রশাসন প্রয়োজন।
রাণীনগর ও আদমদিঘী (বগুড়া) সংবাদদাতাঃmd.shakil ahmed

No comments:

Post a Comment